নিজস্ব প্রতিবেদক, বাংলানিউজলাইন ডটকম:8:43:09 PM02/21/2021
স্বাধীনতা পুরস্কার ও বাংলা একাডেমি পদকপ্রাপ্ত অধ্যাপক যতীন সরকার বলেছেন, বিশ্বের সব জ্ঞান বিজ্ঞানকে আমাদের নিয়ে আসতে হবে।নিয়ে আসতে হবে আমাদের বাংলা ভাষায়।যার জন্যে যেখানে যতটুকু প্রয়োজন সেখানে ততটুকু ইংরেজিভাষার চর্চা ভালভাবেই করতে হবে। কিন্তু কোন অবস্থাতেই ইংরেজির দাসত্ব করা চলবেনা। কিংবা বিদেশী ভাষার দাসত্ব করা চলবেনা। সর্বত্র বাংলাভাষার প্রচারের জন্যে যা যা করা দরকার যেখান থেকে যেভাবে করা দরকার সেখান থেকে সেভাবেই করতে হবে।
প্রায় ৫৫টি গ্রন্থের লেখক যতীন সরকার একুশের চেতনা নিয়ে এই প্রতিবেদককে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, একুশের চেতনা নিয়ে আমরা অনেক বড় বড় কথা বলি।বিশেষ করে ফেব্রুয়ারি মাস আসলেই সর্বত্র এসব কথা শোনা যায়।কিন্তু একুশের চেতনাকে যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করার জন্যে প্রশাসন থেকে আরম্ভ করে অন্যান্য মানুষ বিশেষ করে হঠাৎ যারা ধনী হয়ে গেছে সেই ধনী ব্যক্তিরা কোন গরজতো করেনই না বরং একুশের চেতনার বিরোধী কাজকর্ম তারা সম্পন্ন করেন। সেই কাজ কমের্র মধ্যে হচ্ছে ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয় সর্বত্র প্রতিষ্ঠা করা এবং ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয়ে ছেলে মেয়েদেরকে পড়ানো। ছেলেদেরকে বাংলাভাষা ভালভাবে শিখানোর যে ব্যাপারটা সেটি পর্যন্ত নয়। কাজেই এই অবস্থাতে একুশের চেতনা বাস্তবায়নের কথা মুখে বলা একটা একেবারে অনর্থক বলা। এই বলার অর্থ নাই। একুশের চেতনা যদি সত্যি সত্যি বাস্তবায়ন করতে চাই তাহলে আমাদের সর্বত্র বাংলাভাষা যাতে প্রচারিত হয় সেই ব্যবস্থাটি করতে হবে।অফিস আদালতে বাংলা ভাষার ব্যবহার করতে হবে।বিচারকদের বাংলায় রায় দিতে হবে।সর্বত্র এই বাংলা যদি প্রচারিত না হয় এবং সর্বত্র যদি বাংলা মাধ্যম স্কুল চালু না হয়। ইংরেজি ভালভাবে শিখার ব্যবস্থা বাংলা মাধ্যম স্কুলেই হতে পারে।ইংরেজি ভালভাবে শিখে এসে সেই বাংলামাধ্যমে প্রচার করার ব্যবস্থা করতে হবে।এইটি না করলে যথার্থ অর্থে একুশের চেতনার বাস্তবায়ন আমরা করতে পারবোনা।
তিনি বলেন, ভাষার যে আন্দোলন সেটা মুলত সাংস্কৃতিক আন্দোলনই ছিল।ভাষা আন্রেদালনের মধ্য দিয়ে আমরা রবীন্দ্রনাথকে চিনেছি।আমরা ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে নজরুলের খন্ডিকরণের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছি।ভাষা আন্দোলনের মধ্যদিয়ে রবীন্দ্র সংগীত আমাদের সমাজে প্রচলনের ব্যবস্থা করেছে।ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে রবীন্দ্র চর্চা যেমন হয়েছে তেমনি বাংলাভাষাকে সঠিকভাবে ব্যবহার যে চর্চা সেটিও হয়েছে।কাজেই এটি প্রকৃত প্রস্তাবে একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলন ছিল।সেই সাংস্কৃতিক আন্দোলনই এক সময় রাজনৈতিক আন্দোলন এবংতারপরে সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রামে পরিণত হয়েছে। আমরাতো এখন সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রামের কথা বলিনা।আমরা বলি সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রামের মধ্যদিয়ে স্বাধীনতা লাভ করেছি।কিন্তু বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন,যে মুক্তির সংগ্রাম আমাদের সংগ্রাম।সেই মুক্তির সংগ্রাম বিজয় লাভ করতে হবে। আমাদের সর্বত্র অনেক কিছু করতে হবে। এই অনেক কিছুর মধ্যে সবচেয়ে বড় যে জিনিষটা আমাদের যে ভাষা সেই ভাষার যথাযথ বিস্তার ঘটাতে হবে।মানুষ মাতৃভাষায় কথা বলে এবং মাতৃভাষায় যে কথা বলাটা সেইটা মাতৃভাষায় চিন্তা করে বলেই মাতৃভাষায় বলি।মানুষ যে ভাষায় চিন্তা করে সেই ভাষায়ই কথা বলি।মাতৃভাষা ছাড়া অন্য ভাষায় কেউ চিন্তা করতে পারেনা।অন্যভাষায় যখন একজন লোকে কা বলে তখন প্রকৃত অর্থে সেই ভাষাকে অনুবাদ করে নেয়া কাজেই অনুবাদের মাধ্যমে অন্য একটি ভাষা ভাল করে শিখলে খুব তাড়াতাড়ি অনুবাদ করতে পারে। আসলে এটা কোন অনুবাদই না।অন্য ভাষায় চিন্তা করা যায় না। চিন্তার ভাষা হচ্ছে মাতৃভাষা।কাজেই আমাদের মাতৃভাষার উন্নতির জন্য করণীয় সব বিষয় সম্পন্ন করা উচিৎ।
বাংলাভাষাটাকে সত্যিকার অর্থে প্রচার করতে হলে বিদেশী ভাষাটাকেও ভাল করে জানতে হবে।ইংরেজির সাথে ঐতিহাসিকভাবেই আমরা পরিচিত।কাজেই ইংরেজি ভাষাটাও ভাল করে শিখতে হবে।ভাল করে শিখার সঙ্গে সঙ্গে সেটা মাতৃভাষায় অনুবাদ করলে কি দাঁড়ায় সেই বিষয়টাও ভাল করে শিখতে হবে।এছাড়া বাংলাভাষার ব্যাপক প্রচার করার আর কোন উপায় নাই।
যতীন সরকার বলেন, ঘটনা ঢাকায় ঘটলেও এটা যে গ্রামাঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃতি হয়েছিল সেটার স্বাক্ষী আমি নিজেই। আমি তখন দশম শ্রেণীর ছাত্র। আমি স্কুল থেকে বের হয়ে গিয়ে বসুর বাজার হরতাল করি। সমস্ত মানুষ সেই হরতালে স্বস্ফুর্তভাবে যোগ দেন। এইভাবে প্রত্যেকটা গ্রামের বাজারে বাজারের হরতাল হয়। সর্বত্র যখন একুশের চেতনার কথা লেখা হয় তখন সেটা বড়জোর মহকুমা পর্যন্ত এসে থেমে যায়।যদি গ্রামাঞ্চলে কৃষকদের মধ্যে, কৃষকদের সন্তানদের মধ্যে চেতনা বিস্তৃত না হতো তাহলে একুশ এতো বিস্তৃত হতে পারতো না।আমরা সবাই বলি একুশের চেতনার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার চেতনা লাভ করেছি।একটা স্বাধীকার সংগ্রাম আমরা করেছি। একুশের চেতনার মধ্য দিয়ে একটা সাংস্কৃতিক সংগ্রাম তৈরী হয়েছিল।এখন সেই সাংস্কৃতিক ধারাটা বদলে গেছে। আমরা একুশের চেতনাকে মুখে মুখে বলি। একুশে ফেব্রুয়ারি আসলেই ানেক কথা বলি। কিন্তু একুশের চেতনাকে বাস্তবায়ন করার জন্যে যথার্থ অর্থে বাংলাভাষার যে সর্বত্র ব্যবহার এবংআমাদের সংবিধানে যে রাষ্ট্রভাষা বাংলার কথা বলা হয়েছে সেইখানে সর্বত্র বাংলাভাষার ব্যবহারতো নাই। বরং আজকে কিছু সংখ্যক মানুষ ইংরেজি মাধ্যমে ছেলে মেয়েদেরকে পড়াতে পারলে বিশেষ খুশি হন। ইংরেজি মিশ্রিত ভাষার বলার যেটাকে বাংলিশ ভাষা বলা হয় ওইরকম একটা ধারা চলছে।
শিক্ষার মাধ্যম বাংলাভাষা হওয়া উচিত। বাংলাভাষার মাধ্যমে পৃথিবীর জ্ঞান বিজ্ঞান বিভিন্ন ভাষা থেকে নিয়ে আসা উচিত এই বিষয়েও চেতনা জাগ্রত হয় নাই। একুশের ইতিহাস সঠিকভাবে লেখা হউক। চেতনা জাগ্রত হউক এটাই একুশের দিনের সবচেয়ে আমার বড় ভাবনা। একুশের চেতনা জাগ্রত করতে হলে একটা সাংস্কৃতিক আন্দোলন করতে হবে। যেমন ৬০এর দশকে গড়ে উঠেছিল।সেই রকম একটা সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলা ছাড়া একুশের চেতনাকে জাগ্রত করা সর্বত্র প্রসারিত করা সম্ভব হবে না।
বাংলানিউজ লাইন.কম এ প্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, তথ্য, ছবি, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট বিনা অনুমতিতে ব্যবহার বেআইনি।